ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের পেছনে মোট চারটি কারণ

লেখক:
প্রকাশ: ২ মাস আগে

একদিকে ভাদ্রের অসহনীয় গরম, অন্যদিকে তীব্র লোডশেডিংয়ের কারণে গত কয়েকদিন ধরেই সাধারণ মানুষের নাকাল অবস্থা। এই ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের পেছনে মোট চারটি কারণ চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে রয়েছে ড’লার সংকট ও আমদানি নির্ভরতাসহ বিভিন্ন কারণে জ্বালানি সংকট, অতিরিক্ত গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়া; কুলিং লোড বৃদ্ধি এবং অপরিকল্পিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও সরবরাহ লাইন না থাকা।

বিদ্যুৎখাতে আরও সংকটের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এখনই পদক্ষেপ না নিলে আগামীতে আরও বেশি সমস্যা হবে। বিগত সরকারের অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়নের খেসারত দিতে হবে জনগণকে।

দেশে বর্তমানে উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হলেও চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের কম। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত না করে অপরিকল্পিতভাবে দেশে কয়েক বছরে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। তারা বলছেন, গত সরকার অর্থনৈতিক যে বিপর্যয় রেখে গেছে, তারই ফলশ্রুতিতে এই পুরো খাত মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই খাতে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। সম্পূর্ণ টাকা দেওয়া সম্ভব না হলেও যতটুকু টাকা দিয়ে সরবরাহ বজায় রাখা যায়, ততটুকু দিতে হবে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যে দেখা গেছে, বুধবার প্রকৃত উৎপাদন ছিল ১২ হাজার ৮৬৯ মেগাওয়াট (দিনে), অথচ এর বিপরীতে বৃহস্পতিবারের চাহিদা ১৪ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। আর গতকাল সন্ধ্যায় প্রকৃত উৎপাদন ছিল ১৪ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট, এর বিপরীতে চাহিদা ১৫ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট।

উৎপাদন ও চাহিদার এই অসামঞ্জস্যতার কারণে বুধবার মধ্যরাত থেকে ঢাকার কিছু এলাকাসহ সারা দেশের অনেক উপজেলায় লোডশেডিং হয়েছে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) হিসাব বলছে, ঘণ্টাপ্রতি লোডশেডিং কোনও কোনও সময় দুই হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তবে বাস্তবে বা বিতরণ কোম্পানির হিসাবে দেখা যাচ্ছে, লোডশেডিংয়ের পরিমাণ আরও বেশি। একই অবস্থা বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডেরও (আরইবি)।

ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। এ দুটি সংস্থার দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বুধবার ঢাকায় আগের দিনের চেয়ে লোডশেডিং বেড়েছে। দুটি সংস্থা মঙ্গলবার দিনের বেলায় সর্বোচ্চ ১০০ মেগাওয়াট করে ঘাটতি পেয়েছিল। রাতে ডিপিডিসির ঘাটতি ২০০ মেগাওয়াট ছাড়ায়। গতকাল দিনেও ডেসকো এলাকায় ১৬০ মেগাওয়াট ও ডিপিডিসি এলাকায় ২০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। এতে করে রাজধানীর কোনও কোনও এলাকায় এক ঘণ্টা, কোথাও দুই ঘণ্টা করে লোডশেডিং হয়েছে।

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ নোমান বলেন, গতকাল আমাদের চাহিদা ছিল ১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে সরবরাহ পাওয়া গেছে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। ফলে গ্রাহকদের যাতে কোনও সমস্যা না হয় সেটি মাথায় রেখে লোড ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে কাজ করতে হচ্ছে আমাদের। তাও সব এলাকায় দিনে অন্তত দুইবার এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। আশা করছি, উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়লে এই সমস্যা কেটে যাবে।

লোডশেডিংয়ের অন্যতম কারণ জ্বালানি সরবরাহ না থাকায় উৎপাদন কমে যাওয়া। ডলার সংকটের কারণে উৎপাদন কমেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে। একইসঙ্গে জ্বালানির আমদানি নির্ভর এ খাতে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছে সরকারের বকেয়াও বাড়ছে। ফলে চাহিদা মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। এতে চাহিদার সাথে জোগানের অনেক ফারাক থেকে যাচ্ছে, ফলে লোডশেডিং হচ্ছে।

দেশে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ আসে গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট। আগে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। অথচ এখন পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ খাত দিনে ১২০ থেকে ১৩০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ পেয়েছে। এখন ৮০ থেকে ৮৫ কোটি ঘনফুট সরবরাহ হচ্ছে বলে জানিয়েছে পিডিবি। কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের মাধ্যমে দিনে গ্যাস আসে একশ দশ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল গত ২৭ মে থেকে বন্ধ। ফলে এখন সরবরাহ হচ্ছে ৬০ কোটি ঘনফুট।

এদিকে, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব ইউনিট। ফলে মঙ্গলবার তিন হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি লোডশেডিং ছিল। ভারতের ঝাড়খণ্ডে নির্মিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। দিনে দেড় হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল। কিন্তু বকেয়া পরিশোধ না করায় এখন এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে তারা।

শেখ হাসিনার সরকার ব্যাংক থেকে বন্ড ছেড়ে বেসরকারি খাতের বকেয়া বিদ্যুৎ বিল কিছুটা কমাতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের এখনও অনেক বকেয়া রয়েছে। গ্যাস বিল, সরকারি–বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল, ভারতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল সব কিছু মিলিয়ে পিডিবির বকেয়া টাকার পরিমাণ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে বকেয়া অর্থ চেয়ে চিঠি দিয়েছেন ভারতের আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, জ্বালানির এই আমদানি নির্ভরতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। যা সরাসরি ডলারের ওপর চাপ তৈরি করেছে। আমদানি নির্ভরতার সংকটের দৃষ্টান্ত হিসেবে ২০২২-২৩ সালকে উল্লেখ করছেন বিশ্লেষকরা। জ্বালানি আমদানির জন্য অতিরিক্ত ১৩ বিলিয়ন ডলার খরচ হয় ওই বছর।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা এ খাতকে চরম অব্যবস্থাপনার খাত হিসেবে অভিহিত করেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের হিড়িক পড়ে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইন পাস করে এগুলোকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়। এ আইনের অধীনে দরপত্র ছাড়াই একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ব্যবসায়ীরা ছাড়াও আওয়ামী লীগ নেতারাও বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানা নেন।

অনেক পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করা হলেও সেগুলো থেকে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ অর্থের অভাবে গ্যাস ও তেল কেনা যাচ্ছে না। এরকম বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চুক্তি স্থগিত বা রিনিউ করা হয়নি।

দেশের দক্ষিণে চারটি বড় বড় কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এগুলো হলো পায়রা, রামপাল, এস আলম এবং মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র।

এসব কেন্দ্র থেকে মোট উৎপাদন সক্ষমতা পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু সরবরাহ লাইন না থাকার কারণে এগুলো থেকে বিদ্যুৎ ঢাকার দিকে আনা যাচ্ছে না। অথচ তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়।

তারা বলছেন, এখন ক্যাপাসিটির অসুবিধা নেই। কিন্তু সরবরাহ লাইনের সীমাবদ্ধতা আছে। ফলে উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না।

এসির ব্যবহার বাড়ায় কুলিং লোডের কারণে লোডশেডিং ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) অনেক বেশি ব্যবহারের কারণে কুলিং লোড বাড়ছে। গরম বাড়লে এসির ব্যবহার আরও বেশি বাড়ে। দেশে এমন কুলিং লোডের পরিমাণ রয়েছে ৩ হাজার মেগাওয়াটের মতো। গরম পড়লেই মানুষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার বাড়িয়ে দেয়, এতে করে বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়ে যায়। বছরের যে সব সময়ে কুলিং লোড কম থাকে, ওই সময়গুলোয় বিদ্যুৎ সরবরাহ অনেকটা স্বাভাবিক থাকে।

সামগ্রিক বিষয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেছেন, সাময়িক সংকট সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ডলারে পেমেন্ট করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আশা করছি, আমরা একটি সমাধানে যেতে পারবো।

এদিকে, বুধবার এক অনুষ্ঠানে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যুতের বর্তমান অবস্থার উন্নতি হবে। তিনি বলেন, বড়পুকুরিয়ায় কারিগরি সমস্যা হয়েছে যা দ্রুত মেরামত করা হচ্ছে, রামপাল পুনরায় চালু হয়েছে, আদানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে ও দ্রুত গ্যাস আমদানি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যুতের বর্তমান অবস্থার উন্নতি হবে।